ধর্ম ও স্বাধীনতা: দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত – সলিমুল্লাহ খান

Briddha(গতকালের পর)

মানুষ ধর্ম পালন করে কেন? বাহিরের চোখে দেখিলে মনে হইবে ধর্ম মানে তো আচার আর অনুষ্ঠান। কে না জানে আচার আর অনুষ্ঠানে থাকে নিয়মের বাধ্যবাধকতা। আর বাধ্য হওয়া মানেই তো এক ধরনের অধীনতা। অথচ একটু ভিতর হইতে দেখিলে দেখিবেন মানুষ এমনকি অধীনতাও মানিয়া লয় শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভ করিবার আশায়। ধর্মের আচার বিচারও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নহে।

আলজিরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম হইতে উদাহরণ টানিয়া ফ্রানৎস ফানোঁ দেখাইয়াছেন স্বাধীনতার বাসনা সে দেশের জনসাধারণের মধ্যে অনেক বিষয়ে নতুন আচার ব্যবহারের জন্ম দিয়াছিল। শুদ্ধমাত্র নারীজাতির গায়ের পোশাকের কিংবা বেতারযন্ত্রের উদাহরণেই তিনি আবদ্ধ থাকেন নাই। আধুনিক এয়ুরোপ হইতে আনীত চিকিৎসাশাস্ত্র আর ওষুধপত্রের ক্ষেত্রেও এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছেন ফানোঁ। আমরা এখানে ওষুধপত্র আর চিকিৎসাশাস্ত্রের কাহিনীটা কহিতেছি।

ফরাশিরা আলজিরিয়া দেশটা দখল করিবার পর সেখানে অন্যান্য কাজের মধ্যে আধুনিক চিকিৎসাসেবা, ফরাশি ডাক্তারবৈদ্য এবং সুন্দর সুন্দর হাসপাতাল আর ফার্মেসিও প্রবর্তন করেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনকে অপছন্দ করিবার কারণে এইসব ভাল ভাল জিনিশও আলজিরিয়ার মুসলমান সমাজ প্রত্যাখ্যান করেন। তাহারা শুদ্ধ ফরাশি ডাক্তার নহে, এয়ুরোপিয়া চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত দেশীয় ডাক্তারদের পর্যন্ত এড়াইয়া চলিতেন। ফরাশি ডাক্তারদের বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাইত ডাক্তার আর পুলিশ-মিলিটারিতে ভেদটা সামান্যই। সকলেই পরদেশলোভে মত্ত ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা বিশেষ। ডাক্তারও প্রয়োজনে লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করিত।

কিন্তু যখন সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হইল, সব কিছুর মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগিল। ফরাশিরা আলজিরিয়ার নাগরিকদের নিকট ওষুধপাতি বেচা বিক্রির ক্ষেত্রে প্রথমে রেশনিং আর খানিক পরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা শুরু করিল। বিশেষ করিয়া অ্যান্টিবায়োটিক আর অ্যান্টি-টিটেনাস সিরাপ (এটিএস) নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হইল। আলজিরিয়ার অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এটিএস প্রতিষেধকের অভাবে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যুবরণ করিতে বাধ্য হইলেন।

ফরাশিরা যে ওষুধকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিশাবে ব্যবহার করিতেছে তাহা আলজিরিয়া হাড়ে হাড়ে টের পাইল। এই সময় ফরাশি সরকার নির্দেশ দিয়াছিল কোন ফার্মেসি যেন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আলজিরিয়ার লোকের কাছে না বেচে। আর বেচিলেও যেন নাম ঠিকানাসহ রোগীর তাবৎ বৃত্তান্ত লিখিয়া রাখে। যে ফার্মেসি আপনাকে বলিল ওষুধটা স্টকে নাই কারণ আপনি আলজিরিয়ার মুসলমান সেই ফার্মেসিই দশ মিনিটের মধ্যে আরেকজনের হাতে সেই ওষুধটা তুলিয়া দিল, কারণ সে বেটা ফরাশি। এই সময় আলজিরিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ফরাশি ডাক্তারের অপেক্ষায় বসিয়া না থাকিয়া নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা দিতে শুরু করিয়াছিলেন। সেই সময় ধর্মপরায়ণ আলজিরিয়ার লোকজন চোরাবাজারে ফরাশি ওষুধ কিনিতে শুরু করে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তো সংগ্রহ করিতেই হইবে।

আলজিরিয়ার ‘অশিক্ষিত’, ‘গোঁড়া’ মুসলমান মুক্তিযুদ্ধের দুর্মর দিনে এইভাবে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে ইমান আনিল। ব্যাপারটা বেশ মজার কারণ বহুদিন ধরিয়া চেষ্টা করিবার পরও ফরাশি ডাক্তাররা এই আলজিরিয়াবিদের ফরাশি ওষুধ গিলাইতে পারেন নাই। হাসপাতালে ডাক্তারের সহিত একদিন দেখা করিয়া পরের দিন তাহারা আর আসিতেন না — লাপাত্তা হইয়া যাইতেন।

এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হইল। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন অনুসারে বিপ্লবী আলজিরিয়া আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই সুফলগুলি বর্জন না করিয়া গ্রহণ করিতে শিখিল। ঘটনা দুইটা — মুক্তিযুদ্ধ ও ওষুধশাস্ত্র — একসঙ্গে হাজির হইল। বিপ্লব ও স্বাধীনতা মানুষের ধর্মে বা আচার ব্যবহারে বিপুল পরিবর্তন আনিতে পারে। কয়েকটা উদাহারণের সহায়তায় ফানোঁ ইহা দেখাইতেছেন।

একদা ফরাশি ঔপনিবেশিক সরকার আলজিরিয়ার গ্রামেগঞ্জে মহল্লায় মহল্লায় আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা চালু করিতে চাহিয়াছিলেন। মানুষ সেই সুপরামর্শ তখন গ্রহণ করে নাই। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন বিপ্লবী সরকার বলিলেন এইসব পায়খানা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল তখন লোকে দলে দলে এইগুলি বসাইতে শুরু করিল। মানুষের অন্ত্র হইতে আগত পরজীবী কীট যে রোগজীবাণু ছড়ায় সেই শিক্ষাটা মানুষ অতি দ্রুতবেগে গ্রহণ করিল।

মানুষ হাজামজা পুকুর সংস্কার করিল। শিশুর জন্মের পর যে অপতালমিয়া রোগের প্রকোপ দেখা দিত তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে দ্রুত অগ্রগতি দেখা দিল। মায়েরা বাচ্চার যতেœ ত্র“টি করিতেন না। এখন সমস্যা শুদ্ধ আরিওমাইসিনের অভাবে সীমিত হইল। এখন লোকে সুস্থ থাকিতে ব্যগ্র হইল, ডাক্তার-নার্সের সুপরামর্শে বেশি বেশি করিয়া কান দিতে লাগিল। নার্সিংবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিদ্যালয় খোলা হইল। দেখা গেল কয়েকদিন শিক্ষা লইবার পর এমনকি নিরক্ষর চাষীরাও ধমনীর মধ্যে কেমন করিয়া ইনজেকশনের সূঁচ ফুঁড়াইতে হয় শিখিয়া লইল।

একই কায়দায় দেখা গেল একদা যাহারা ঝাড়ফুঁকে, ওঝায়বৈদ্যে বিশ্বাস রাখিতেন তাহারও ধীরে ধীরে এইসব ছাড়িয়া দিলেন। একদা জিন পরিতে বিশ্বাস করাকে এসলাম ধর্মের অঙ্গ মনে করা হইত। বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এইসব মোল্লাকি চিকিৎসার কবর রচিত হইল। মুক্তিযুদ্ধ আলজিরিয়ায় এসলাম ধর্মেরও নতুন ব্যাখ্যা হাজির করিল।

ফানোঁ দুই দুইটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা খোলাসা করিয়াছেন। যেসব সমাজে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার বিশেষ বিকাশ ঘটিয়াছে সে সমাজেও কিছু কিছু শিক্ষা সর্বসাধারণের মধ্যে বিস্তারিত করা যায় নাই। বা গেলেও তাহা করা কঠিন প্রমাণিত হইয়াছে। কিন্তু আলজিরিয়ার সর্বস্তরের লোকজন এই শিক্ষা দ্রুত আত্মস্থ বা আমল করিয়াছেন। আর এসলাম মুক্তিযুদ্ধের পর নবজীবন লাভ করে — এই কথাটাও পুনরায় প্রমাণ লাভ করিল।

বিপ্লবের পক্ষের স্বদেশি ডাক্তারদের এখন আলজিরিয়া ‘আপন’ ডাক্তার বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে। তাঁহাদের নির্দেশ এখন সকলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তখন একটা নিয়ম প্রচার করা হইয়াছিল এই রকম: কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি তলপেটে আঘাত পাইয়া আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন তবে তাঁহাকে কোনক্রমেই পানি খাইতে দেওয়া যাইবে না। এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় যাহাতে না ঘটে সেই নির্দেশ খুব কড়া আকারে প্রচার করা হয়। বাড়ির প্রত্যেকটি ছেলে ও মেয়েকে এই নিয়মটি জানাইয়া দেওয়া হইল। দেখা গেল আহত মুক্তিযোদ্ধা ‘পানি’ ‘পানি’ করিয়া চিৎকার করিতেছেন কিন্তু তাঁহার ছেলেও তাঁহাকে পানি দিবে না। ছেলে বাবাকে বলিল, ‘আব্বা, এই বন্দুকটা হাতে লইয়া আপনি ইচ্ছা করিলে আমাকে গুলি করেন। তবুও আমি আপনাকে পানি দিতে পারিব না।’ ডাক্তার আসিয়া অপারেশন করিলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা আছে। পানি দিলে সে সম্ভাবনা নষ্ট হইবে।

আরেক উদাহারণ। টাইফাস সংক্রমণের বেলায় রোগীকে কয়েকদিন কোন কঠিন খাবার দেওয়ার বিষয়ে নিষেধ ছিল। কোন পিঠাপুলি কিংবা মুরগীর মাংস দেওয়া একদম নিষেধ ছিল। আত্মীয়স্বজন যখন রোগীর বিছানার কাছে ভিড়িবার সুযোগ পায় তখন রোগীর অতি অনুরোধে তাহাকে এহেন খাবার আত্মীয়স্বজন দিতেও পারেন। তাই এই ধরনের রোগীর বেলা, বলা হইত পরিবারের লোকজন যেন তাহার দর্শনে না যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা গিয়াছে আলজিরিয়ার মুক্তিযোদ্ধার মায়েরাও ডাক্তারের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছেন। বাচ্চাকে খাবার না দিয়া বসিয়া থাকিয়াছেন। কয়েক দিন। তাহার আশপাশেও ঘেঁষেন নাই।

ফানোঁ বলেন, ‘জাতির দেহে প্রাণের সঞ্চার হইলে, জাতি যদি এককাট্টা হইয়া চলিতে থাকে, তখন সকলই সম্ভবপর হয়।’

দোহাই

Frantz Fanon, A Dying Colonialism (London Penguin Books,1970).

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

মন্তব্য করুন