Category Archives: সর্বজন: নবপর্যায় ৩৫

মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুর জাতীয়তা–মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী

শিক্ষক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী ১৮৮৬ সনের তৎকালীন ফরিপুর জিলার পাংশা থানায় জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলনের সময় অংশগ্রহনের কারণে তিনি কারাবরণ করেন। এর ফলে তাঁহার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হইয়া যায়। এর পর তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও সংবাদপত্র চালনাসহ সাতিহ্যকর্ম চালাইয়া যান। আজিকার প্রবন্ধে তাঁহার সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দেখিতে পাইব। সেইকালে ভারতীয় মুসলমানরা একান্ত নিরুপায় হইয়া খেলাফত আন্দোলনে শরিক হইতে বাধ্য হইয়াছিল। কিন্তু খোদ তুরস্কে খেলাফতি সিলসিলা রদ হইয়া যাইবার পর এই আন্দোলনে আর না থাকিয়া রবং যৌক্তিকভাবেই তিনি ইহা মানিয়া লইয়াছিলেন। কারণ ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা এক রূপ কুয়াশা মাত্র। ইহা তিনি ভালই উপলব্ধি করিয়াছিলেন। সর্বাগ্রে তৎকালীন পরিবেশে বর্ণ হিন্দুরা যে স্বার্থ সিদ্ধির কারণেই মুসলমানদের দূরে ঠেলিয়া দিয়াছিছেল ইহা কহিতেও তিনি কসুর করেন নাই। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এই মনীষী এন্তেকাল করিয়াছিলেন

ভারতীয় জাতি-গঠনকারী হিন্দুগণ মুসলমানদিগের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের কথা বলিয়া থাকেন। তাঁহার বলেন যে, মুসলমানগণ অতিমাত্রায় সাম্প্রদায়িক, তাঁহাদের দৃষ্টি কেবল মাত্র স্ব-সম্প্রদায়ের মঙ্গল-চিন্তাতেই নিবদ্ধ। অখণ্ড দেশকে তাঁহারা ভালবাসেন না। কিংবা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সমস্ত দেশবসীর মঙ্গলকর কোন কর্ম-চেষ্টাও তাঁহাদের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহারা কেবল স্বীয় সম্প্রদায়ের ইষ্ট সাধন করিতে পারিলেই সন্তুষ্ট। মুসলমানদিগের এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব হইতেই ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক পৃথক নির্বাচনের উৎপত্তি এবং এই পৃথক নির্বাচনের ফলেই ঘোর সাম্প্রদায়িক কলহ-বিবাদে দেশ ধ্বংস হইয়া যাইতেছে ও এক নিখিল ভারতীয় জাতি গড়িয়া উঠিতে পারিতেছে না।

এক্ষণে বিচার করিয়া দেখিতে হইবে যে, মুসলমানদিগের বিরুদ্ধে ভারতের জাতি গঠনের পথে বিঘœস্বরূপ এই সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ সত্য কিনা, সত্য হইলে শুধু তাঁহারাই এই অপরাধে অপরাধী না। হিন্দুরাও সমভাবে সাম্প্রদায়িকাতা-দোষে দুষ্ট। দেখিতে হইবে ভারতীয় জাতি-গঠনের অনুকূল পরম প্রেম-মূলক একান্ত জাতীয়-মনোভাব বাস্তাবিক হিন্দুদিগের মধ্যে বিদ্যমান আছে, না ভারতীয়তার অন্তরালে তাঁহারাও শুধু সাম্প্রদায়িক স্বার্থেরই সাধনা করিতেছেন।

ভারতীয় মুসলমানগন যে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রকাশে একান্ত সাম্প্রদায়িক হইা অতি বড় সত্য কথা। ইহা অস্বীকার করিবার ও গোপন করিবার কোন কারণ নাই। হইা আবিষ্কার বা পরিহার করিবার জন্য তর্ক করিবারও প্রয়োজন নাই। রাষ্ট্রীয় জীবনে পদক্ষেপ করিয়া কর্ম-জীবনের মধ্যে মাথা তুলিয়া মুসলমানগণ স্বসম্প্রদায়ের ইহাই চাহিতেছে; স্বসম্প্রদায়ের স্বার্থ ও অধিকার বুঝিয়া পাইবার জন্যই দিনরাত তাঁহারা সংগ্রাম করিতেছে, সাম্প্রদায়িক বিশিষ্ট সুবিধার জন্যই তাঁহারা রাষ্ট্রীয় জীবনের মাথা হইতে পা পর্যন্ত পৃথক বা নির্দিষ্ট নির্বাচনের অধিকার চাহিতেছে। এই যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও হিন্দুদিগের নিকট হইতে পৃথক করিয়া অধিকার বুঝিয়া লইবার চেষ্টা, ইহা মুসলমানদিগের আত্মপ্রকাশের স্বাভাবিক ক্রিয়া মাত্র। ইহার মধ্যে গভীর সত্য ও প্রেরণা আছে। কোন হীন ও সাময়িক স্বার্থ লাভের চিন্তা হইতে ইহার উৎপত্তি হয় নাই। মুসলমানদিগের মধ্যে এই স্বতন্ত্র স্বার্থে চিন্তার ও পৃথক অধিকারের বুদ্ধি আসিল কোথা হইতে? কে এই মনোবৃত্তি তাঁহাদের মধ্যে জাগাইয়া দিল? এই কথাটা ভাল করিয়া চিন্তা করিতে হইবে ও গভীর করিয়া বুঝিতে হইবে।

মুসলমানেরা কি ভারতে মুসলমান-রাজত্ব স্থাপন করিতে চায়? সেই জন্যই কি তাঁহারা দেশের পার্সি, খ্রীস্টান, জৈন, হিন্দু প্রভৃতি ভিন্ন সম্প্রদায়ের সমস্ত দেশবাসীকে বাদ দিয়া কেবল মুসলমানদিগের উন্নতির জন্যই ব্যাকুল ও ব্যাগ্র? নব-জাগ্রত তুর্কি, আফগান ও আরবের সাহায্যে মুসলমানেরা ভারতে অচিরেই ইসলামের বিজয়-পতাকা উত্তলন করিবে, এই দূরাশায় কি ভারতীয় মুসলমানদিগের সর্বপ্রকার রাজনৈতিক কর্ম-চেষ্টা তলে তলে রহিয়া গিয়াছে? সেই জন্যই কি তাঁহারা দেশবাসীর সাধারণ স্বার্থের জন্য ভারতীয় জাতি গঠনের নিমিত্ত মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন বোধ করে না?

স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, এইরূপ চিন্তা পাগলের কল্পনা ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না। স্বরাজ লাভের পূর্বে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে ইংরাজের কামান বন্দুকের মুখে বাস করিয়া ও দ্বিবিধ পরাধীনতার মধ্যে থাকিয়া ভারতের মুসলমানগণ এমন চিন্তা স্বপ্নেও মনে স্থান দিতে পারে না। পরাধীন ভারতীয় মুসলমানের সুখ-দুঃখের কথা বিদেশী স্বাধীন কোন মুসলমান জাতির মাথায় স্থান পায় না, স্থান পাওয়া সম্ভবও নয়। নিজেদের ভাগ্য লইয়াই তাঁহারা বিব্রত। জাগ্রত তরুণ তুর্কী লুসেন-সন্ধি বৈঠকের সময় শত প্রকারে সহানুভূতিশীল ভারতীয় মুসলমানের সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে একটি কথা বলা প্রয়োজনবোধ করে নাই। কেবল তাহাই নহে, খেলাফত তিন তুড়িতে উড়াইয়া দিবার সময় মহাবীর কামাল পাশা ভারতীয় মুসলমানের সাহায্যের প্রতি অবজ্ঞার হাসি হাসিতে ত্রুটি করেন নাই। তাঁহার বিরুদ্ধে  বিষতিক্ত বাক্য উচ্চারণ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। হেজাজে যে বিশ্ব-মুসলেম সম্মিলনীর অধিবেশন হইয়া গিয়াছে, তাহার রূপ-ছবিও আমরা দেখিয়াছি। নববল-দৃপ্ত আরব ভারতীয় মুসলমানদিগের সম্মানিত প্রতিনিধি ও অবিসম্বাদিত নেতা আলী-ভাইদিগের প্রতি উপযুক্ত সমাদর প্রদর্শন করা প্রয়োজনবোধ করে নাই। ফলতঃ, ইসলামের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃভাব দেশ কাল ও গিরি-মরুর সীমা অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইলেও মমতাভেদ মানুষের স্বাভাবিকবৃত্তি বলে মুসলমানদিগের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। প্রত্যেক জাতির হৃদয় তাহার জন্মভূমির আকর্ষণে আনন্দিত হয়, স্বদেশের সম্পদ- গৌরবে তাহার হৃদয় নন্দিত হয়। নববলে বলীয়ান তরুন তুর্কী বা আফগান যদি ঘটনাক্রমে এই দেশ অধিকার করে তবে তাহা তুর্কী বা আফগানেরই রাজত্ব হইবে, ভারতীয় মুসলমানের রাজত্ব হইবে না। সেই অধীনতার পেষণ হিন্দুর ন্যায় মুসলমানদিগকেও সমভাবে ভোগ করিতে হইবে। এই নব প্রতিষ্ঠিত রাজত্বেও সুখ-সুবিধার স্বর্ণ-তরুণ উদঘাটিত হইবে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য নয়, তুরস্ক বা কাবুলের মুসলমানের জন্য। ভারতের ধনশ্রোত তখন লন্ডন হইতে ফিরিয়া আঙ্গোরা বা কাবুলের দিকেই প্রবাহিত হইবে। বাঙ্গলার ম্যালেরিয়া ও কালা-জ্বর-জীর্ণ পল্লী-প্রাঙ্গণে চিহ্নবাস-পরিহিত মুসলমান কৃষক-কুলের কুটিরে রজত-কাঞ্চনের হাসি ফুটিবে না। এখন তাহারা যেমন করিয়া মরিতেছে, তখনও তাহারা তেমনি করিয়াই মরিবে। এই ভারতের বুকেই রাজত্ব লইয়া মুসলমানে মুসলমানে বহু রক্তপাত হইয়া গিয়াছে। বংশের পর বংশ ধরিয়া মুসলমানের কত রক্ত ভারতের গঙ্গা-যমুনা রঞ্জিত করিয়াছে। দাসের পর তোগলক, তোগলকের পরে গিলিজি আসিয়াছে, পাঠানের রাজমুকুট মোগল আসিয়া কাড়িয়া লইয়াছে। মোগলের সিংহাসন পার্সি নাদির আসিয়া ভাঙ্গিয়া লইয়াছে। মুসলমান বলিয়া অপর মুসলমানকে হত্যা করিতে লুণ্ঠত করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। স্পেনে যখন খ্রীস্টানের হস্তে মুসলমানেরা ধর্ম্ম ও সিংহাসন চূর্ণ হইতেছিল, তাহাদের চিহ্ন পর্যন্ত লুপ্ত হইতেছিল, তখন ভারতে মুসলমান মোগলশক্তি সমৃদ্ধির সিংহাসনে সমাসীন। সেই সিংহাসন হইতে শাহান্শাহ্গন স্পেনবাসী মুসলমানদীগের শোচনীয় অবস্থার প্রতি কোনরূপ সহানুভূতি প্রকাশের প্রয়োজন বোধ করেন নাই। আধুনিক যুগে ইউরোপীয় মহাযুদ্ধে বিপন্ন তুর্কীকে অবহেলায় পরিত্যাগ করিয়া মিসরের মুসলমান স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্যের পতাকা তুলিয়া ইংরাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়াছে। খ্রীস্টান ইংরাজের সাহায্য লইয়া আরব তাহার সহধর্মী তুর্কী ভাইকে স্বদেশ হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে। মুসলমান বলিয়া আরব তুর্কীর অধীনে জীবন যাপন করিতে সম্মত হয় নাই। ধর্ম-গুরু খলিফার প্রভুত্ব পর্যন্ত তাহারা অস্বীকার করিয়াছে।

ভৌগোলিক সীমা, ভাষা, আবহাওয়া ও আহার-পরিচ্ছদের বিভিন্নতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন দেশে নিতান্ত স্বভাবধর্ম অনুসারেই ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রমণ্ডল গড়িয়া উঠিয়াছে। খ্রীস্টান-ইউরোপে ইংরাজ, ফরাসী, জার্মানি, রাশিয়া যে নিয়মে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে পরিণত হইয়াছে, সেই একই কারণে মোসলেম এশিয়া ও আফ্রিকায় আরব, তুরস্ক, ইরান, আফগান, মিসর, মরক্কো, তিউনিস ও সুদান ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রমণ্ডলে পরিণত হইয়াছে। এমন কি, এক ভাষা সত্ত্বেও মরক্কোর মুসলমান মিসরের মুসলমানের সঙ্গে মিলিত হইয়া এক রাজত্ব গঠন করে নাই। সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও রাজ্য গঠনের এই স্বাভাবিক ক্রিয়া কি শুধু ভারতবর্ষেই বিফল বলিয়া প্রমাণিত হইবে? কেবল ভারতের মুসলমানগণই আপনাদের দেশ ভাষা ও রুচিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়া শুধু মুসলমান বলিয়া তুর্কী তাতার কাবুলের অধীনতা বরণ করিয়া লইবে?

সুতরাং তুরস্ক বা কাবুলের সঙ্গে মিত্রতা করিয়া ভারতে মুসলমান রাজত্ব স্থাপন করিবার অভিপ্রায়েই ভারতীয় মুসলমানগণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ-লাভের দিকে দৃষ্টি দিয়া বসিয়া থাকে ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে পৃথক-নির্বাচন বা নির্দিষ্ট অধিকার লাভের চেষ্টা করে, ইহা নিতান্তই অমূলক চিন্তা। তৈমুর লঙ্গ ও নাদির শাহ্ ভারতের বুক বহু মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত করিয়াছে। ভারতীয় মুসলমানের বহু ধনরতœ লুণ্ঠিত হইয়া কাবুল ও তাতারের পথে চলিয়া গিয়াছে। ইহা ভারতীয় মুসলমানগণ ভুলিয়া যাইতে পারে না। ভারতে মোসলেম রাজ্য স্থাপনের অমূলক আশঙ্কা যে কুহেলিকা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহা ভেদ করিয়া মুসলমানদিগের সাম্প্রদায়িক হিত-বুদ্ধির মূলে কি চিন্তা ক্রিয়া করিতেছে, তাহা এখন আমাদিগকে পরিষ্কার করিয়া বুঝিতে হইবে।

এক একটি পরিবারে যাহা ঘটে, এক একটি জাতির জীবন ও রাষ্ট্রীয় সুখ-দুঃখ তাহারই বৃহত্তর বিকাশ মাত্র। হিন্দু ও মুসলমান শুধু এক দেশবাসী বলিয়াই ভাই। কিন্তু পরিবাওে পরিবারে দেখিতে পাই, যাহারা এক রক্তের রক্ত, এক বৃন্তের ফুল, এক মায়ের সন্তান, সেই একান্ত সত্য-সহোদর ভাইগণ স্বার্থের জন্য, প্রয়োজনের নিমিত্ত, আত্মরক্ষার চিন্তায়, পরস্পরের সহিত বিস্ময়কর ও ভয়াবহ কলহে লিপ্ত হয়। দেখা যায়, কনিষ্ঠ সহোদর আপনার অধিকার যখনই ভালভাবে বুঝিয়া না পায়, তখনই জ্যেষ্ঠের নিকট হইতে তাহার সম্পত্তি পৃথক করিয়া লইবার দাবী উপস্থিত করে, এবং যে পর্যন্ত তাহার এই পৃথক অধিকারের দাবী পরিবার-মণ্ডলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্তৃক স্বীকৃত ও সম্পাদিত না হয়, সে পর্যন্ত সে কলহ করিতে, মামলা করিতে, এমন কি রক্তপাত করিতেও কুণ্ঠিত হয় না।

কনিষ্ঠ ভাইয়ের এক পৃথক অধিকার লাভের বুদ্ধি আসে কোথা হইতে? সাধারণতঃ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্বার্থপরতা ও অতিরিক্ত প্রভুত্ব-প্রিয়তা হইতেই ইহার জন্ম। ছোট ভাই যখন দেখিতে পায়, পরিবারের ধন-সম্পত্তি বড় ভাইয়ের ভোগে যেমন করিয়া লাগিতেছে তাহার নিজের ভোগে তেমন করিয়া লাগিতেছে না, সম্পত্তির উপর বড় ভাইয়ের প্রভুত্ব যেমন করিয়া চলিতেছে, তাহার নিজের অধিকার তেমন করিয়া চলিতেছে না, তখনই তাহার মনে পৃথক অধিকার লাভের চিন্তা মাথা তুলিয়া দেখা দেয় এবং সে তাহা লাভ করিবার জন্য বিবাদ করিতে প্রবৃত্ত হয়। সুবিধা ও ক্ষমতা যাহার হাতে থাকে, সে সাধারণতঃ তাহার অপব্যবহারই করিয়া থাকে। অপরের স্বার্থ ও অধিকার মানিবার ও বুঝিয়া দিবার সুবুদ্ধি অতি অল্প লোকের মধ্যেই দেখিতে পাওয়া যায়। এই নিমিত্ত অধিকাংশ পরিবারেই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অল্পবয়স্ক ও অনুন্নত কনিষ্ঠদিগের অধিকার ন্যায়ের সঙ্গে বুঝিয়া দিবার দিকে লক্ষ্য রাখে না। ফলে গৃহবিবাদ উপস্থিত হয় ও কনিষ্ঠ ভাইয়েরা বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। কনিষ্ঠ ভাইয়েরা যতদিন ছোট থাকে, যতদিন তাহাদের জ্ঞানবুদ্ধি পরিপক্ক না হয়, যতদিন তাহারা নিজেদের সত্তা ও অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হইয়া না ওঠে, ততদিন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রভুত্ব ও পরিবারের শান্তিতে কোনই বিঘœ উপস্থিত হয় না। কিন্তু এই প্রকার শান্তিকে শান্তি বলা চলে না। বিপদ আসে তখনই যখন ছোট ভাইগণ বয়স্ক, বুদ্ধিমান ও অধিকার-বুদ্ধিতে সচেতন হইয়া সংসারে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চায়, যখন তাহারা মানুষরূপে বাঁচিতে, বুঝিতে ও সকল অধিকার গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হয়। বড় ভাই যখন নিজের পতœীকে স্বর্ণালঙ্কারে মণ্ডিত করে, আপনার ছেলেমেয়েকে সুন্দর সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত করে, আর ছোট ভাই তাহার পতœী ও সন্তানদিগের অনুরূপ সুখ-সুবিধা বিধানের সুবিধা পায় না, প্রতি পদে সেখানে তাহার স্বাধীন চিন্তা ব্যাহত হয়, তাহার প্রাণের সাধ মনের মধ্যে গুমরিয়া ফিরে, তখনই তাহার মনোমধ্যে আপনার অধিকার পৃথক করিয়া লইবার চিন্তা জাগ্রত হয়।

প্রতি পরিবারে ভ্রাতৃ-বিরোধের ইহাই ইতিহাস। প্রত্যেক মানুষ আপনার স্বতন্ত্র সত্তার প্রকাশ পাইতে ইচ্ছা করে। ছোট ভাই তাহার অধিকারের জন্য যে বিরোধ করে, ধন-সম্পত্তি পৃথক করিতে সংগ্রাম করে, বড় ভাইয়ের স্বার্থপরতা হইতে তাহার জন্ম এবং ছোট ভাইয়ের আত্মচেতনা ইহাতেই ইহার প্রেরণা।

পরিবারিক জীবনে যাহা ঘটিতেছে, জাতীয় জীবনেও তাহা ঘটিতে পারে। মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যেমন আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চায়, সমষ্টিরূপে সে তেমনি আপনার বিচিত্র আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বতন্ত্র সত্তা প্রকাশ করিতে লালায়িত হয়। সহোদর যেমন সহোদরের সঙ্গে বিরোধ করে, আপনার অস্তিত্ব ও অধিকারের জন্য মুসলমানের পক্ষের তেমনই হিন্দুর সঙ্গে কলহ করা বিচিত্র নহে। হিন্দুর স্বার্থপরতা হইতে ইহার জন্ম, মুসলমানের আত্মচেতনা ও আত্মপ্রকাশের চিন্তা হইতে ইহার উৎপত্তি।

দোহাই:

মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর পুস্তাকাকারে অপ্রকাশিত রচনাবলী, আব্দুল কাদির সম্পাদিত, বাঙলা একাডেমী, কার্তিক: ১৩৭০, ঢাকা।

প্রথম প্রকাশ: সওগাত, ৫ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, আষাঢ় ১৩৩৪।

লর্ড বার্ট্রান্ড রাসেল সমীপে বার্তা–হো চি মিন

আপনি আমেরিকান যুদ্ধাপরাধীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক গণআদালত গঠন করিয়াছেন, এই উপলক্ষ্যে আমি আপনাকে আমার গভীরতম অভিনন্দন জানাইতেছি। ভিয়েতনামের জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরা যুদ্ধের মাত্রা বৃদ্ধি করিতেছে। তাহারা যে পাশবিক অত্যাচার আর অপরাধ করিতেছে তাহা হিটলারীয় ফ্যাসিবাদি নির্মমতাকে হার মানাইয়াছে। আন্তর্জাতিক গণআদালত এহেন অপরাধের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নিন্দা এবং দুনিয়াব্যাপী এই অপরাধ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিবে। সেই সাথে ভিয়েতনাম হইতে মার্কিন দালাল সৈন্যবাহিনী অপসারনের বজ্রনিনাদ তুলিবে।

বার্ট্রান্ড রাসেল

বার্ট্রান্ড রাসেল

ন্যায়বিচারের দাবিতে এবং জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের খাতিরে ইহার গুরুত্ব আন্তর্জাতিক। মানব জাতির ও বিশ্ব শান্তির পহেলা শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে দুনিয়ার মানুষের বিবেক জাগাইতে এই গণআদালত অবদান রাখিবে। চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভিয়েতনামের জনগণ আপনাদের এই মহৎ উদ্যোগে অন্তর হইতে শুভেচ্ছা জানাইতেছে। আমরা আপনাদের হৃদয় উজাড় করা সাধুবাদ জানাইতেছি। আশা করি আপনি এই হৃদয় নিংড়ানো অভিনন্দন গণআদালতের সর্বজনকে পৌঁছাইয়া দিবেন। আমি গণআদালতের সর্বাঙ্গ সাফল্য কামনা করি।

একান্ত আপনার,

হো চি মিন। নবেম্বর ১৯৬৬

উৎস: Against U.S Aggression For National Salvation. Ho Chi Minh. Foreign Languages publissing House. Hanai- 1967

তর্জমা: প্রিয়ম পাল

অনুবাদকের টীকা:

১৯৪০ সালে জার্মানি ফ্রান্সের বড় অংশ দখল করিয়া দালাল সরকার কায়েম করে। অচিরে জাপান ইন্দোচীন দখল করে। চিনে ঘাঁটি গাড়িয়া  হো চি মিন জাপানি ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের জাতীয় ঐক্য ফৌজ গঠন করেন। ১৯৪৫ সালে মার্কিনিরা জাপানকে পরাস্ত ও নিরস্ত্র করে। তখন হো চি মিন রিপাবলিক ঘোষণা করেন। বিধি বাম! ফরাসি বাহিনী ফিরিল। তখন হো চি মিন ফরাসিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। জেনারেল গিয়াপ এই মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি। ১৯৫৪ সালে দিয়েনবিয়েন ফুতে ফরাসিদের লড়াইয়ে শোচনীয় হারে যুদ্ধের ফয়সালা হইয়া যায়। জেনেভায় বহুজাতিক এক সম্মেলনে শান্তিচুক্তি হয়। তাহাতে ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ দুই রাষ্ট্রে ভাগ হয়। হো হন উত্তরের রাষ্ট্রপতি। দক্ষিণের হবু রাষ্ট্রপতি দিয়েমকে আমেরিকা মুলুক থেকে নগদ আমদানি করা হইল।

জঁ পল সার্ত্র

জঁ পল সার্ত্র

১৯৫০-এর পূর্ব হইতেই দুনিয়ায় সমাজতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাহার পবিত্র কর্তব্য বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছিল। ভিয়েতনামে দেশভাগ হইলে পর মার্কিনরা দক্ষিণের দিয়েমশাহীর হাত শক্ত করিতে তোড়জোড় শুরু করিল। সিআইএ — মানে মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা ইহাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

অবশেষে ১৯৫৯-৬০ সাল নাগাদ দেশকে মুক্ত ও পুনরায় একত্র করিতে ভিয়েতনামের কমুনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নেয়। তখন দক্ষিণে জাতীয় মুক্তি ফৌজ গঠিত হয়। আমেরিকায় তখন কেনেডি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হইলেন। তিনি ভিয়েতনামে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করিলেন। এই বিশেষ বাহিনী দক্ষিণের দালাল সরকারের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ সমেত নানা সহায়তা করিত। যাহা হউক ১৯৬৫ সালে আসিয়া মার্কিনিরা ভাবিল আর অপেক্ষা করা যাইতেছে না। এখনই দক্ষিণে সকল মুক্তিযুদ্ধ দমন করিতে হইবে। ১৯৬৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন সেনাবাহিনী উত্তর ভিয়েতনামে বোমাহামলা ও দক্ষিণে মুক্তিযুদ্ধ দমনে ব্রতী হয়। এই পরিস্থিতিতে হো ১৯৬৬ সালে বক্তৃতাটি দিয়াছিলেন।

মার্কিনিদের সহিত অল্পাধিক অস্ট্রেলীয়, নিউজিল্যান্ডীয় ও দক্ষিণ কোরীয় সৈনিকও দক্ষিণ ভিয়েতনামে ছাউনি ফেলিয়াছিল।

ইংরেজ দার্শনিক লর্ড বার্টান্ড রাসেল ১৯৬৬ সালের নবেম্বর মাসে ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধাপরাধের বিচার করিতে একটি গণআদালত গঠন করিয়াছিলেন। ডিসেম্বর মাসে হো তাঁহাকে অভিনন্দন করিয়া বার্তাটি পাঠান।

ফরাসি দার্শনিক জঁ পল সার্ত্র এই উদ্যোগে রাসেলের সতীর্থ হইয়াছিলেন, আরও অনেক মনীষীই হইয়াছিলেন।

রাসেলগঠিত এই গণআদালত ১৯৬৭ সালে সুইডেন ও ডেনমার্কে অধিবেশন করে। তাহাতে অপরাধে মার্কিন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযুক্ত হয়।

১৯৯২ সালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক দালালদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিচার করিবার লক্ষ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণে এবং জাহানারা ইমাম, কর্নেল নুরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির প্রমুখের অগ্রণী ভূমিকার দ্বারা যে গণআদালত গঠা হয় তাহা — কবিরের সাক্ষ্য অনুসারে — রাসেলগঠিত গণআদালতের আদল দ্বারা অনুপ্রাণিত।

সমগ্র দেশের মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান–হো চি মিন

জনগণ না চাইলেও হররোজ সহিংসতা চলছেই সূত্র: ইন্টারনেট

জনগণ না চাইলেও হররোজ সহিংসতা চলছেই
সূত্র: ইন্টারনেট

হে দেশের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ,

আমাদের দেশ দখল করিবার মানসে বর্বর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা আগ্রাসী যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু তাহারা ক্রমাগত নাস্তানাবুদ হইতেছে।

তাহারা তড়িঘড়ি করিয়া আমাদের দেশের দক্ষিণে মোতাবেক ৩ লক্ষের মতন হানাদার সৈন্যের সমাবেশ করিয়াছে। আক্রমণাত্মক কৌশলের অংশ হিসাবে পুতুল প্রশাসন ও ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনী খাড়া করিয়াছে। যুদ্ধে তাহারা যারপরনাই আদিম কায়দার আশ্রয় লইতেছে — যাহার মধ্যে রহিয়াছে ভয়াবহ বিষাক্ত রাসায়নিক, নাপাম বোমা সহ অন্যান্য অস্ত্রাদির নির্বিচার ব্যবহার। তাহাদের নীতি দাঁড়াইয়াছে ‘সব পোড়াইয়া দে, সবাইকে খুন কর এবং সকলই ধ্বংস কর’ নীতি। এহেন অপরাধ করিয়া তাহারা আমাদের দক্ষিণের বাসিন্দাদের শায়েস্তা করিবে বলিয়া পণ করিয়াছে।

কিন্তু জাতীয় মুক্তি জোটের দৃঢ় এবং বিজ্ঞ নেতৃত্বে দক্ষিণ ভিয়েতনামের যোদ্ধা ও জনগণ একযোগে বীরোচিত লড়াই করিতেছে এবং দক্ষিণকে সম্পূর্ণ মুক্ত করিতে, উত্তরকে রক্ষা করিতে আর দেশকে এক করিতে সংগ্রামে উদ্যত হইয়াছে।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা পাগল হইয়া দক্ষিণে তাহাদের ক্ষতি পোষাইয়া নিতে উত্তর ভিয়েতনামে বিমান আক্রমণ শুরু করিয়াছে যেন আমরা তাহাদের শর্ত মত মিটমাট করিতে মরিয়া হইয়া উঠি। কিন্তু উত্তর ভিয়েতনাম ইহাতে ভীত নয়। আমাদের জনগণ ও যোদ্ধারা মনেপ্রাণে যুদ্ধ করিতে আর উৎপাদন বাড়াইতে চেষ্টা করিতেছে। এখন পর্যন্ত আমরা শত্রুর ১,২০০-র অধিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস করিতে সমর্থ হইয়াছি। আমরা শক্রর ধ্বংস-যুদ্ধ রুখিয়া দিতে, আর সেই সাথে দক্ষিণে আমাদের আপন জাতির মানুষদের সর্ববিধ সহায়তা করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

অবস্থাদৃষ্টে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ভীত হইয়া হাইফং ও হ্যানোয়ের আশেপাশে বিমান আক্রমণের দ্বারা যুদ্ধের মাত্রা বৃদ্ধি করিতেছে। তাহাদের এই বেগতিক মাথাখারাপ কর্মকাণ্ডের সহিত তুলনা দেওয়া চলে আহত পশুর অন্তিম ছটফটানির সহতি।

হো চি মিন (১৮৯০-১৯৬৯)

হো চি মিন (১৮৯০-১৯৬৯)

জনসন ও তাহার গোষ্ঠির বুঝা উচিত: তাহারা হয়তো ৫ লক্ষ, ১০ লক্ষ কিংবা তাহারও অধিক সৈন্য দক্ষিণ ভিয়েতনামে আনিয়া আগ্রাসী যুদ্ধকে আরও প্রবল করিতে সক্ষম। তাহারা হয়তো সহস্রাধিক বোমারু বিমান দ্বারা উত্তর ভিয়েতনামে আঘাত হানিতে সমর্থ। কিন্তু জাতীয় মুক্তি অর্জনে জনগণের যুদ্ধ করিবার যে ইস্পাত কঠিন মনোবল রহিয়াছে ইহা তাহারা কখনও ভাঙ্গিতে পারিবে না। যতই তাহারা অত্যাচার করিবে ততই তাহারা পাপের বোঝা বৃদ্ধি করিবে। এই যুদ্ধ পাঁচ, দশ, বিশ কিংবা আরও বহু বৎসর চলিতে পারে। হ্যানয়, হাইফং এবং আরও বহু শহর ও স্থাপনা হয়ত ধ্বংস হইয়া যাইবে কিন্তু ভিয়েতনামী জনগণের দম বিন্দুমাত্র কমিবে না। স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের চাইতে মূল্যবান আর কিছুই থাকিতে পারে না। এক বার জয়ী হইলে আমাদের জনগণ দেশকে পুনরায় গড়িয়া তুলিবে এবং আরও বৃহৎ মনোহর স্থাপনায় সাজাইয়া তুলিবে।

সকলেই জানেন যখনই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা এই অপরাধ যুদ্ধ বাড়াইবার মতলব ভাঁজিতে থাকে তখনই তাহারা বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দিবার মানসে ‘শান্তি আলোচনা’ নামক কলা ঝুলায়, আর তাহার ‘শান্তি আলোচনায়’ বসিতে অনিচ্ছুক হইলে ভিয়েতনামের মুণ্ডপাত করিয়া থাকে।

রাষ্ট্রপতি জনসন সাহেব, আপনি মার্কিন জনগণ আর বিশ্বের সকল লোকের নিকট প্রকাশ্যে উত্তর দিন: সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, উন্নতি এবং ভিয়েতনামের আঞ্চলিক একত্রিকরণ যাহা জেনেভা চুক্তিতে আছে তাহা কে বরখেলাপ করিল? ভিয়েতনামী সৈন্য কি আমেরিকায় আগ্রাসন চালাইয়াছে কিংবা পাইকারী হারে আমেরিকানদের নিধন করিয়াছে? আমেরিকান সরকারই কি ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালাইতে জঙ্গী বাহিনী পাঠায় নাই এবং তাহারা কি ভিয়েতনামীদের নির্মূল করিতেছে না?

যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আগ্রাসী যুদ্ধ বন্ধ করে, আমেরিকান এবং ভাড়াটিয়া সৈন্যদের এখান হইতে প্রত্যাহার করিয়া লয় তবে তৎক্ষণাৎ শান্তি সংস্থাপিত হইবে। ভিয়েতনামের দাবী পরিষ্কার, গণপ্রজাতান্ত্রিক ভিয়েতনাম সরকারের ৪টি দাবী আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম জাতীয় মুক্তি ফৌজের ৫টি দাবী। ইহার অন্যথা নাই।

ভিয়েতনামী জগনণ শান্তির কদর করিতে জানে। জনগণ চাহে সত্যকারের শান্তি, স্বাধীনতা আর স্বাধিকারের শান্তি, ছদ্ম শান্তিও নহে, ‘আমেরিকান শান্তি’ও নহে ।

পিতৃভূমি রক্ষা করিতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত জাতির প্রতি আমাদের দায়শোধ করিতে আমাদের দেশের জনগণ এবং সেনাবাহিনী যেনবা এক আত্মায় যুক্ত রহিয়াছে। নির্ভীক তাহাদের আত্মত্যাগ, সকল বাধা ডিঙ্গাইবার সাহস তাহাদের অবিচল; চূড়ান্ত বিজয় না করিয়া লড়াই তাহারা ছাড়িবে না। অতীতে আমরা আরও কঠিন অবস্থায় জাপানী ফ্যাসিবাদী এবং ফরাসী উপনিবাসীদের পরাজিত করিয়াছিলাম। এক্ষণে দেশে এবং বিদেশে সুবাতাস বহিতেছে। মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে জনগণের লড়াই নিশ্চিতরূপে শতভাগ সাফল্য লাভ করিবে।

প্রিয় স্বদেশবাসী ও যোদ্ধাগণ,

আমরা ন্যায়ের পক্ষে — ইহ্ াআমাদের শক্তি; উত্তর হইতে দক্ষিণ পর্যন্ত জনগণ মৈত্রীডোরে আবদ্ধ, অকুতভয় লড়াই করিবার ঐতিহ্য আমাদের রহিয়াছে এবং সারা দুনিয়ার প্রগতিপন্থি জনগণ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সমাজতান্ত্রিক দেশের সাহায্য ও সহানুভূতি আমাদের দিকে রহিয়াছে। জয় আমাদের হইবেই।

নতুন এই পরিস্থিতিতে সকল আত্মত্যাগ আর বাধা পার করিয়া এই গৌরবময় ঐতিহাসিক কার্যসিদ্ধি করিতে আমরা একতাবদ্ধ: মার্কিন আগ্রাসীদের পরাজিত করিবই।

মার্কিন জনগণশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দেশের এবং জগতের সকল কল্যাণকামী জনগণকে তাহাদের হৃদয় উজাড় করা সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য এই সুযোগে ভিয়েতনামী জনগণের পক্ষ হইতে আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল হইতে শুকরিয়া জানাইতেছি। আমি দৃঢ়তার সহিত বিশ্বাস করি যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যতই নতুন নতুন অপরাধের ধরন যুক্ত করিবে ততই ভ্রাতৃপ্রতিম সমাজতান্ত্রিক দেশ ও গোটা বিশ্বের শান্তিকামী ও বিবেকী জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা ভিয়েতনামীদের প্রতি আরও প্রগাঢ় হইবে যতক্ষণ পর্যন্ত না জাতীয় মুক্তি অর্জনে মার্কিন আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পূর্ণ জয় আসে।

ভিয়েতনামী জনগণের জয় হইবেই!

মার্কিন আগ্রাসীদের পরাজয় নিশ্চিত!

সুখী, সমৃদ্ধ, দৃঢ়, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক এবং য্ক্তু ভিয়েতনাম জিন্দাবাদ! সমগ্র দেশের দেশপ্রেমিক এবং যোদ্ধাগণ জোর কদমে আগাইয়া চল!

মধুদার স্মৃতি–আহমদ ছফা

কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে সেটাই মুশকিল। মধুদা মানে মধু দা। তাঁর নামের পদবী কি ছিল ও নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়নি। সত্যি বলতে কি এখনো পর্যন্ত মধুদার পদবীটি আমার জানা হয়নি।

মধুদার নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে লম্বাচওড়া শালপ্রাংশু একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। মহাদেবের মতো চেহারা ছিল মধুদার। গায়ের রঙ একেবারে ধবধবে শাদা। তিনি রোদে রোদে ঘোরাফেরা করতেন বলে দেখাত একটু তামাটে।

শহীদ মধুসূদন দে’র প্রতিকৃতি

শহীদ মধুসূদন দে’র প্রতিকৃতি

মধুদা আদি এবং অকৃত্রিম ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গীটির মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যেটা একেবারে আমাদের মরমে গিয়ে পশতো। তাঁর সঙ্গে আমার ছাত্রজীবনে বেশি কথাবার্তা হয়নি। যাও হয়েছে ঐ বাকি খাওয়া নিয়ে। সারাদিন পাঁচজন মিলে বিশ কাপ চা, দশটা সিঙ্গারা খেয়েছি। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসার সময় বলতাম, মধুদা লিখে রাখেন বিশ কাপ চা, দশটা সিঙ্গারা। শুনে তিনি গজর গজর করতেন: কেবল তো কইয়া যাইতেছেন, এই পর্যন্ত কত অইছে হিসাব রাখছেননি? মধুদা খাতা খুলে হিসাব দেখাতে চাইতেন। আমরা বলতাম, থাক থাক, মধুদা, হিসাব দেখাতে হবে না, সব শোধ করে দেব। আমরা জানতাম মধুদার বাকির খাতায় নাম থাকলেও সকলের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব থাকত না। শুধু ভয় দেখাবার জন্য খাতা খোলার ভঙ্গীটি করতেন। মধুদার সবচাইতে বড় গুণ ছিল তিনি ছাত্রছাত্রীদের অসম্ভব বিশ্বাস করতেন। আমি এমন অনেকের কথা জানি যাদের মধ্যে একজনের বাকির পরিমাণ অনেক, ধরুন একশ টাকা। পঞ্চাশ টাকা মধুদার হাতে দিয়ে বলত, এই আছে। আর দিতে পারব না। তিনি বলতেন, অইছে অইছে, যান।

মধুদা ক্যান্টিনে সকালের দিকে বসতেন না। বাইরে নানা কাজে ঘোরাঘুরি করতেন। দুপুরে সময় পেলে একবার এসে ক্যাশে বসতেন। সময় না পেলে আসতেন একেবারে চারটের পর। এসেই কর্মচারীদের জিগ্যেস করতেন, আইজকা মোয়াজ্জেম সাব আইছিল? তাঁর লোকেরা বলত, হ। তিনি বললেন, লেখো বিশ কাপ চা। জাফর সাব? হ। লেখো বিশ কাপ। এমনি করে যে সমস্ত ছাত্রনেতা মধুর ক্যান্টিনে বসে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতেন, তারা কে কয় কাপ চা খেতেন, মধুদা বলবেন কি তারা নিজেরাও বলতে পারতেন না। অতএব মধুদা অনুমান করে এক একটা সংখ্যা বসিয়ে দিতেন। যেমন মোয়াজ্জেম সাব বিশ কাপ, ফরমান উল্লাহ পনেরো কাপ। চায়ের কাপের অঙ্কটা তো মধুদা বসাতেন। টাকাটা আদায় হত কি না আমার সন্দেহ।

অনেককেই বলতে শুনেছি ডাকসাইটে ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে মধুদা কোন বিল দাবি করতেন না। কেউ জীবনে কেউকেটা হয়ে তাঁর সামনে এসে একদিন দাঁড়ালে তিনি খাতাটা নিয়ে হাজির হতেন। বলতেন, অহন তো খুব বড় ছাব অইছেন, বিল কত বাকি আছে জানেন! পাঁচশ টাকা বাকি থাকলে মধুদা নাকি পাঁচগুণ বাড়িয়ে বলে গলায় গামছা দিয়ে আদায় করতেন। এই সংবাদ লোকমুখে শুনে শুনে আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। কিন্তু একটি ঘটনায় আমার টনক নড়ে।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছি। থাকতাম পুরানা পল্টনের দিকে একটা মেসে। একদিন দেখি মধুদা রাস্তা দিয়ে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছেন। এমনিতে তিনি ধুতিটা শক্ত করে পরতেন এবং সবসময় বকের পাখনার মতো শাদা রাখতে চেষ্টা করতেন। আজ দেখলাম তাঁর ধুতিটা মলিন, জামাটাও। মোটা মানুষ। বোধ হয় দীর্ঘপথ হেঁটে এসেছেন। শরীর দিয়ে দরদর ঘাম ছুটছে। আমি জিগ্যেস করলাম, মধুদা, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? তিনি বললেন, আরে! আমি মনে মনে আপনারেই খোঁজ করতাছি। আমি একটুখানি অবাক হয়ে গেলাম। মধুদা আমার মত হেঁজিপেঁজি মানুষকে খুঁজবেন কেন? তাঁর তো বড় মানুষদের নিয়ে কারবার। আমি বললাম, মধুদা বলুন, কেন আমাকে খুঁজছেন। তিনি বললেন, আপনে কই থাকেন? আমি বললাম, এই কাছেই। একটা মেসে। তিনি বললেন, লন আপনার ঘরে যাই। আমার ঘরে ঢুকেই মধুদা বললেন, আপনি আমারে একশটা টাকা দিবেন। আমি চিনি-ময়দা রেশন উঠাইবার পারি নাই। তারপর মধুদা তাঁর গল্পটা বললেন। আজকে সকাল থেকে তিনজনের অফিসে গিয়েছেন যাদের কাছে মধুদা টাকা পাবেন। কেউ তাঁকে এক আধলাও দেয়নি।

সকলে যে মধুদার টাকা মেরে দিতেন, এটা সত্যি নয়। কাউকে কাউকে আমি বিদেশ থেকে ফিরে এসেও মধুদার টাকা শোধ করতে দেখেছি। একজনের কথা আমার মনে আছে। তিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির। তিনি কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন। ফরেন সার্ভিসে আড়াই কি তিন বছর কাজ করার পরÑআমি তাঁকে দেখেছি–দোকানে এসে মধুদার বাকি পাওনা পরিশোধ করতে।

এ কথাও সত্য যে, অনেকেই মধুদার টাকা দেয়নি। কিন্তু মধুদা কারো নামে মুখ ফুটে নালিশ করেননি। আমার তো মনে হয় না মধুদার সব ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতেন পারব। টাকার কথাটা আমি বলব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সচ্ছল জীবন কাটেনি। মধুদা কেমন করে যেন বুঝতে পারতেন আমার হাতে টাকা নেই। দোকানে বাকিতে খেয়ে যেতাম। মধুদার এই দেখেও না দেখার ভান করার ব্যাপারটিকে অনেকেই বলবেন বোকামি। আমি বলব বড়ত্ব। আসলে মধুদা একজন বড় মাপের মানুষ ছিলেন।

মধু দা: শহীদ মধুসূদন দে স্মারক গ্রন্থ

১ বৈশাখ ১৪০৪

ভূমিকা: সলিমুল্লাহ খান

মহাত্মা আহমদ ছফা এন্তেকাল করিয়াছেন ইংরেজি ২০০১ সালের মধ্যভাগে। তিরোভাবের দশ বছরের মাথায় তদীয় রচনাবলি নয় খণ্ডে বাহির হইয়াছে। তাহার মধ্যে ধরা হয় নাই এমন বহু লেখার দেখা এখনও পাওয়া যাইতেছে। ১৯৯৭ সনে প্রকাশিত ‘মধুদার স্মৃতি’  তাহারই উদাহরণ বিশেষ। ‘মধুদার স্মৃতি’ লেখাটি পাওয়া গিয়াছে ‘মধু দা: শহীদ মধুসূদন দে স্মারক গ্রন্থ’ নামে বাংলা ১৪০৪ ওরফে ইংরেজি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তকে। ইহার সম্পাদনা পরিষদ গঠা হইয়াছিল জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ ছয়জন যশস্বী বুদ্ধিজীবীর নাম লইয়া। ইহার প্রকাশক ‘মধু দা স্মৃতি সংসদ’।

আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)

আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)

‘মধুদার স্মৃতি’ আহমদ ছফার রচনা বলিয়া চিনিয়া লইতে কাহারও কষ্ট হইবার কথা নহে। পহিলা বাক্যেই আহমদ ছফার দস্তখত পরিষ্কার দেখা যায়: ‘কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে সেটাই মুশকিল। মধুদা মানে মধু দা। তাঁর নামের পদবী কি ছিল ও নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়নি। সত্যি বলতে কি এখনো পর্যন্ত মধুদার পদবীটি আমার জানা হয়নি।’ এই একটি বাক্যের মধ্যেই আহমদ ছফা গণতন্ত্রের একটি ভূমিকা লিখিয়া বসিয়াছেন। পদবীতে কিবা আসে কিবা যায়!

পদবীর পরপরই আসে গায়ের রঙ্গ আর মুখের জবান। মধুদার গায়ের রঙ্গ ধবধবে শাদা হইলেও দেখাইত একটু তামাটে। মহাদেবের মত চেহারা হইলেও তাঁহার মুখের জবান ছিল আদি এবং অকৃত্রিম ঢাকাইয়া। মানুষের মুখের বাক্যটাই শেষ বাক্য নহে। মানুষের ভাষার মধ্যে ভঙ্গী বলিয়াও একটি বাক্য আছে। আহমদ ছফা তাহা হইতেই মধুদা ওরফে শহীদ মধুসূদন দের চেহারা আঁকিয়াছেন। কিন্তু মধুর আসল মধু অন্য জায়গায়। ১৯৬০ সালের দশক কি তাহার পরের দশক জুড়িয়া ছাত্রছাত্রীদের জীবন ছিল বাকিতে খাওয়ার জীবন। মধুদা ছাত্রছাত্রীদের উপর বিশ্বাস হারান নাই। তিনি বাকিতে খাওয়াইতেন। আর ছাত্রছাত্রীরাও শেষ পর্যন্ত তাঁহার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেন নাই। মানুষের জীবনের ছবি মাত্র এমন একটি কি দুইটি সরলরেখায় আঁকিতে পারেন আহমদ ছফা। বাংলা লেখার জগতে তাঁহার জুড়ি বেশি পাওয়া ভার। তাঁহার লেখা বাংলা মদের মতন। স্বাদে ও গন্ধে তীব্র। স্বদেশী।

ছাত্রছাত্রীদের জীবন দারিদ্রের জীবন। এই জীবনে বাকিতে খাওয়ায় একটা তাৎপর্য আছে। আহমদ ছফা বিশেষ বলিতে যে দশকের কথা লিখিয়াছেন তাহা ১৯৬০ সালের পরের দশক। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন তখন বেগবান হইতেছিল। একেকটা সময় আসে যখন সময়ের গুণে একেকটা মানুষের ভেতরের গুণ বাহিরে দশগুণ বড় হইয়া জাহির হয়। শহীদ মধুদার জীবনে সেই বড়গুণটা আহমদ ছফা দেখিতে পাইয়াছিলেন। নিজে চিনি-ময়দা রেশন উঠাইতে না পারিলেও ছাত্রছাত্রীদের বাকিতে খাওয়ানো কদাচ বন্ধ করেন নাই মধুদা। আহমদ ছফা এই ‘বোকামি’র মধ্যে মধুদার বড়ত্ব দেখিতে পাইয়াছিলেন। যিনি নিজে বড় নহেন, তিনি মানুষের মধ্যে বড়ত্ব কদাচ দেখিতে পাইবেন না। আহমদ ছফাও বড় মানুষ। তাই তিনি মধুদার বড়ত্ব দেখিয়াছেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঘাতকরা যাঁহাকে রেহাই দেয় নাই — ইতিহাস তাঁহাকে রেহাই দিয়াছে। আহমদ ছফার দুই পাতায় তাঁহার মহত্বের অক্ষয় কাহিনী মহাকাল স্বয়ং লিখিয়াছেন।

একটা জায়গায় আহমদ ছফার খুব সম্ভব একটা স্মৃতিবিভ্রম হইয়াছে। মহৎ মানুষেরও কখনও কখনও স্মৃতির বিভ্রম হয়। আহমদ ছফা এক জায়গায় লিখিয়াছেন, ‘একজনের কথা আমার মনে আছে। তিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির। তিনি কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন। ফরেন সার্ভিসে আড়াই কি তিন বছর কাজ করার পর — আমি তাঁকে দেখেছি — দোকানে এসে মধুদার বাকি পাওনা পরিশোধ করতে।’ এখন মানে ১৯৯৭ সালে যিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন — তিনি নিজেই আমাকে বলিয়াছেন — তিনি আহমদ ছফার শিক্ষক ছিলেন না — ছিলেন শিষ্যস্থানীয় বা বন্ধুতুল্য অনুজ। বিভ্রমের একটা সম্ভাব্য কারণ এই যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরে একই নামের অপর একজন সিনিয়র কূটনীতিক ছিলেন। তিনি সম্প্রতি প্রয়াত হইয়াছেন। তিনি ১৯৬০ দশকের গোড়ায় চট্টগ্রাম জেলার অন্তঃপাতী নাজিরহাট কলেজে শিক্ষক ছিলেন। আহমদ ছফা ছিলেন সেই কলেজের ছাত্র।

ফ্রিডরিখ নিৎসে একদা গুজব রটাইয়াছিলেন ঈশ্বর এন্তেকাল করিয়াছেন। প্রকৃত ঘটনা তাহা নহে। ঈশ্বরের এন্তেকালসংবাদ খানিক অতিরঞ্জিত। জাক লাকাঁর ফতোয়া মোতাবেক বলিতে হইবে ঈশ্বর এন্তেকাল করেন নাই, ঈশ্বর অজ্ঞান হইয়াছেন মাত্র। আমাদের বর্তমান নামবিভ্রাটেও হয়তো তাঁহারই খবর মিলিতেছে।

সম্পাদকীয়: টিকফা চুক্তি সমাচার

গত ২৫ নভেম্বর তারিখে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি ওরফে টিকফা সই হইয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের সহিত এই চুক্তির বন্ধনে আবদ্ধ হইবার ইচ্ছা দীর্ঘ দিনের। অপরপক্ষে বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিদের পক্ষ হইতেও যুক্তরাষ্ট্রের ডাকে এই চুক্তিতে ধরা পড়িবার আগ্রহ ঐকান্তিক বলিয়া লক্ষ্য করিয়াছি। ২০০১ সনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা টিফা চুক্তির প্রস্তাব দেয়। পরবর্তীতে এই টিফাই টিকফায় রূপান্তরিত হয়। উভয় পক্ষের অত্যন্ত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার পক্ষ হইতে এই চুক্তির প্রবল বিরোধিতা আসায় সরকার এতদিন চুক্তি স্বাক্ষরে বিরত ছিল। বিশেষত এই চুক্তির বিষয়ে বিরোধিতার প্রধান কারণ হইল এই চুক্তি সম্পাদিত হইলে আমাদের দেশের কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের উপর নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়িবে। এই চুক্তি মোতাবেক আমাদিগকে ২০২১ সাল হইতে মেধাসত্ত্ব আইনের কঠোর নিগড়ে বাধা পড়িতে হইবে এবং স্বভাবতই এই আইনের জাতাকলে পড়িয়া এ দেশে প্রযুক্তি চিকিৎসা ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থের দাম বাড়িয়া যাইবে। বিশেষত ওষুধ শিল্পে হইার প্রভাব হইবে অত্যন্ত বাজে। এই আইন কার্যকর হইলে মেধাসত্ত্বের কারণে এই দেশের ওষুধ কারখানাগুলো অনেক ওষুধ নিজেরা তৈয়ার করিতে পারিবে না। আমাদিগকে বিদেশী ওষুধের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িতে হইবে এবং ওষুধের দামও অনেকগুণ বাড়িবে বৈকি। গরিব মানুষেরা চিকিৎসার প্রয়োজনে ওষুধ ব্যবহার হইতে বঞ্চিত হইবে।

চুক্তি সই হইবার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে যে বক্তব্য ছাড়া হয় সেইখানে দেখা যায় চুক্তির খসড়ার প্রস্তাবনায় প্রধান চারিটি বিষয় বিদ্যমান রহিয়াছে। এগুলো হইল: সংরক্ষণশীল বাণিজ্য ও বিনিয়োগনীতি পরিহার করিবার প্রয়োজনীয়তা, মেধাসত্ত্ব অধিকার সংরক্ষণের গুরুত্ব, দুর্নীতি বিরোধী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনের গুরুত্ব এবং শ্রম অধিকার বিষয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার। বাংলাদেশের মত একটা অনুন্নত দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ঔপনিবেশিক খবরদারি আরও পাকাপোক্ত করিবার জন্য এই প্রস্তাবনাগুলো ভালই কাজে দিবে বলিয়া মনে হইতেছে। খবরে প্রকাশ যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্ক এক শতাংশ অন্যদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের উপর যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক ১৫%। অথচ টিকফা চুক্তির কোথাও বাংলাদেশি পণ্যের উপর ধার্যকৃত এই বিরাট শুল্ক কমাইবার কথা নয়। বিশেষত এই চুক্তির সহিত পণ্য রপ্তানির কোন সম্পর্কই নাই।

অনেক প্রতিবাদ ও আপত্তির মুখেও সরকার তাহার মেয়াদের শেষ সময়ে আসিয়াও এই চুক্তি করিতে ভুলে নাই। গত ১৭ জুন মন্ত্রী সভায় এই চুক্তির অনুমোদন দেওয়া হইয়াছিল। আর দেশব্যাপি সরকার ও বিরোধী দলের সংঘাত হানাহানির মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদন করা হইল। একইভাবে আমরা লক্ষ্য করিয়াছি জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছে। আসলে তাহারা এই সবের মাধ্যমে বহিশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদি প্রভুদের নিকট তাহাদের দায় মিটাইতে চাহিতেছে। বিশেষ টিকফা চুক্তির বিষয়ে বিরোধী দল বলিয়াছে এই চুক্তি সহি হওয়াটা অত্যন্ত ইতিবাচক। এইভাবে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানাবিধ দেশের স্বার্থক্ষুণœকারী চুক্তি সম্পাদিত হইয়া আসিতেছে। প্রতিবারের মত এইবারও সরকারের পক্ষ হইতে প্রচার করা হইল এই চুক্তি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করিয়াছে। বস্তুত সত্য ঘটনা হইল দেশ ও জনগণ দিনকে দিন আরও অধঃপতিত অবস্থায় পতিত হইতেছে। হায় একটা দুর্ভাগা দেশ ও তার অসহায় জনগণকে এমনি কত না আশ্চর্য বিষয় প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করিতে হয়।