শিক্ষক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী ১৮৮৬ সনের তৎকালীন ফরিপুর জিলার পাংশা থানায় জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলনের সময় অংশগ্রহনের কারণে তিনি কারাবরণ করেন। এর ফলে তাঁহার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হইয়া যায়। এর পর তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও সংবাদপত্র চালনাসহ সাতিহ্যকর্ম চালাইয়া যান। আজিকার প্রবন্ধে তাঁহার সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দেখিতে পাইব। সেইকালে ভারতীয় মুসলমানরা একান্ত নিরুপায় হইয়া খেলাফত আন্দোলনে শরিক হইতে বাধ্য হইয়াছিল। কিন্তু খোদ তুরস্কে খেলাফতি সিলসিলা রদ হইয়া যাইবার পর এই আন্দোলনে আর না থাকিয়া রবং যৌক্তিকভাবেই তিনি ইহা মানিয়া লইয়াছিলেন। কারণ ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা এক রূপ কুয়াশা মাত্র। ইহা তিনি ভালই উপলব্ধি করিয়াছিলেন। সর্বাগ্রে তৎকালীন পরিবেশে বর্ণ হিন্দুরা যে স্বার্থ সিদ্ধির কারণেই মুসলমানদের দূরে ঠেলিয়া দিয়াছিছেল ইহা কহিতেও তিনি কসুর করেন নাই। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এই মনীষী এন্তেকাল করিয়াছিলেন
ভারতীয় জাতি-গঠনকারী হিন্দুগণ মুসলমানদিগের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের কথা বলিয়া থাকেন। তাঁহার বলেন যে, মুসলমানগণ অতিমাত্রায় সাম্প্রদায়িক, তাঁহাদের দৃষ্টি কেবল মাত্র স্ব-সম্প্রদায়ের মঙ্গল-চিন্তাতেই নিবদ্ধ। অখণ্ড দেশকে তাঁহারা ভালবাসেন না। কিংবা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সমস্ত দেশবসীর মঙ্গলকর কোন কর্ম-চেষ্টাও তাঁহাদের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহারা কেবল স্বীয় সম্প্রদায়ের ইষ্ট সাধন করিতে পারিলেই সন্তুষ্ট। মুসলমানদিগের এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব হইতেই ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্প্রদায়িক পৃথক নির্বাচনের উৎপত্তি এবং এই পৃথক নির্বাচনের ফলেই ঘোর সাম্প্রদায়িক কলহ-বিবাদে দেশ ধ্বংস হইয়া যাইতেছে ও এক নিখিল ভারতীয় জাতি গড়িয়া উঠিতে পারিতেছে না।
এক্ষণে বিচার করিয়া দেখিতে হইবে যে, মুসলমানদিগের বিরুদ্ধে ভারতের জাতি গঠনের পথে বিঘœস্বরূপ এই সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ সত্য কিনা, সত্য হইলে শুধু তাঁহারাই এই অপরাধে অপরাধী না। হিন্দুরাও সমভাবে সাম্প্রদায়িকাতা-দোষে দুষ্ট। দেখিতে হইবে ভারতীয় জাতি-গঠনের অনুকূল পরম প্রেম-মূলক একান্ত জাতীয়-মনোভাব বাস্তাবিক হিন্দুদিগের মধ্যে বিদ্যমান আছে, না ভারতীয়তার অন্তরালে তাঁহারাও শুধু সাম্প্রদায়িক স্বার্থেরই সাধনা করিতেছেন।
ভারতীয় মুসলমানগন যে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রকাশে একান্ত সাম্প্রদায়িক হইা অতি বড় সত্য কথা। ইহা অস্বীকার করিবার ও গোপন করিবার কোন কারণ নাই। হইা আবিষ্কার বা পরিহার করিবার জন্য তর্ক করিবারও প্রয়োজন নাই। রাষ্ট্রীয় জীবনে পদক্ষেপ করিয়া কর্ম-জীবনের মধ্যে মাথা তুলিয়া মুসলমানগণ স্বসম্প্রদায়ের ইহাই চাহিতেছে; স্বসম্প্রদায়ের স্বার্থ ও অধিকার বুঝিয়া পাইবার জন্যই দিনরাত তাঁহারা সংগ্রাম করিতেছে, সাম্প্রদায়িক বিশিষ্ট সুবিধার জন্যই তাঁহারা রাষ্ট্রীয় জীবনের মাথা হইতে পা পর্যন্ত পৃথক বা নির্দিষ্ট নির্বাচনের অধিকার চাহিতেছে। এই যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও হিন্দুদিগের নিকট হইতে পৃথক করিয়া অধিকার বুঝিয়া লইবার চেষ্টা, ইহা মুসলমানদিগের আত্মপ্রকাশের স্বাভাবিক ক্রিয়া মাত্র। ইহার মধ্যে গভীর সত্য ও প্রেরণা আছে। কোন হীন ও সাময়িক স্বার্থ লাভের চিন্তা হইতে ইহার উৎপত্তি হয় নাই। মুসলমানদিগের মধ্যে এই স্বতন্ত্র স্বার্থে চিন্তার ও পৃথক অধিকারের বুদ্ধি আসিল কোথা হইতে? কে এই মনোবৃত্তি তাঁহাদের মধ্যে জাগাইয়া দিল? এই কথাটা ভাল করিয়া চিন্তা করিতে হইবে ও গভীর করিয়া বুঝিতে হইবে।
মুসলমানেরা কি ভারতে মুসলমান-রাজত্ব স্থাপন করিতে চায়? সেই জন্যই কি তাঁহারা দেশের পার্সি, খ্রীস্টান, জৈন, হিন্দু প্রভৃতি ভিন্ন সম্প্রদায়ের সমস্ত দেশবাসীকে বাদ দিয়া কেবল মুসলমানদিগের উন্নতির জন্যই ব্যাকুল ও ব্যাগ্র? নব-জাগ্রত তুর্কি, আফগান ও আরবের সাহায্যে মুসলমানেরা ভারতে অচিরেই ইসলামের বিজয়-পতাকা উত্তলন করিবে, এই দূরাশায় কি ভারতীয় মুসলমানদিগের সর্বপ্রকার রাজনৈতিক কর্ম-চেষ্টা তলে তলে রহিয়া গিয়াছে? সেই জন্যই কি তাঁহারা দেশবাসীর সাধারণ স্বার্থের জন্য ভারতীয় জাতি গঠনের নিমিত্ত মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন বোধ করে না?
স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, এইরূপ চিন্তা পাগলের কল্পনা ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না। স্বরাজ লাভের পূর্বে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে ইংরাজের কামান বন্দুকের মুখে বাস করিয়া ও দ্বিবিধ পরাধীনতার মধ্যে থাকিয়া ভারতের মুসলমানগণ এমন চিন্তা স্বপ্নেও মনে স্থান দিতে পারে না। পরাধীন ভারতীয় মুসলমানের সুখ-দুঃখের কথা বিদেশী স্বাধীন কোন মুসলমান জাতির মাথায় স্থান পায় না, স্থান পাওয়া সম্ভবও নয়। নিজেদের ভাগ্য লইয়াই তাঁহারা বিব্রত। জাগ্রত তরুণ তুর্কী লুসেন-সন্ধি বৈঠকের সময় শত প্রকারে সহানুভূতিশীল ভারতীয় মুসলমানের সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে একটি কথা বলা প্রয়োজনবোধ করে নাই। কেবল তাহাই নহে, খেলাফত তিন তুড়িতে উড়াইয়া দিবার সময় মহাবীর কামাল পাশা ভারতীয় মুসলমানের সাহায্যের প্রতি অবজ্ঞার হাসি হাসিতে ত্রুটি করেন নাই। তাঁহার বিরুদ্ধে বিষতিক্ত বাক্য উচ্চারণ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। হেজাজে যে বিশ্ব-মুসলেম সম্মিলনীর অধিবেশন হইয়া গিয়াছে, তাহার রূপ-ছবিও আমরা দেখিয়াছি। নববল-দৃপ্ত আরব ভারতীয় মুসলমানদিগের সম্মানিত প্রতিনিধি ও অবিসম্বাদিত নেতা আলী-ভাইদিগের প্রতি উপযুক্ত সমাদর প্রদর্শন করা প্রয়োজনবোধ করে নাই। ফলতঃ, ইসলামের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃভাব দেশ কাল ও গিরি-মরুর সীমা অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইলেও মমতাভেদ মানুষের স্বাভাবিকবৃত্তি বলে মুসলমানদিগের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। প্রত্যেক জাতির হৃদয় তাহার জন্মভূমির আকর্ষণে আনন্দিত হয়, স্বদেশের সম্পদ- গৌরবে তাহার হৃদয় নন্দিত হয়। নববলে বলীয়ান তরুন তুর্কী বা আফগান যদি ঘটনাক্রমে এই দেশ অধিকার করে তবে তাহা তুর্কী বা আফগানেরই রাজত্ব হইবে, ভারতীয় মুসলমানের রাজত্ব হইবে না। সেই অধীনতার পেষণ হিন্দুর ন্যায় মুসলমানদিগকেও সমভাবে ভোগ করিতে হইবে। এই নব প্রতিষ্ঠিত রাজত্বেও সুখ-সুবিধার স্বর্ণ-তরুণ উদঘাটিত হইবে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য নয়, তুরস্ক বা কাবুলের মুসলমানের জন্য। ভারতের ধনশ্রোত তখন লন্ডন হইতে ফিরিয়া আঙ্গোরা বা কাবুলের দিকেই প্রবাহিত হইবে। বাঙ্গলার ম্যালেরিয়া ও কালা-জ্বর-জীর্ণ পল্লী-প্রাঙ্গণে চিহ্নবাস-পরিহিত মুসলমান কৃষক-কুলের কুটিরে রজত-কাঞ্চনের হাসি ফুটিবে না। এখন তাহারা যেমন করিয়া মরিতেছে, তখনও তাহারা তেমনি করিয়াই মরিবে। এই ভারতের বুকেই রাজত্ব লইয়া মুসলমানে মুসলমানে বহু রক্তপাত হইয়া গিয়াছে। বংশের পর বংশ ধরিয়া মুসলমানের কত রক্ত ভারতের গঙ্গা-যমুনা রঞ্জিত করিয়াছে। দাসের পর তোগলক, তোগলকের পরে গিলিজি আসিয়াছে, পাঠানের রাজমুকুট মোগল আসিয়া কাড়িয়া লইয়াছে। মোগলের সিংহাসন পার্সি নাদির আসিয়া ভাঙ্গিয়া লইয়াছে। মুসলমান বলিয়া অপর মুসলমানকে হত্যা করিতে লুণ্ঠত করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। স্পেনে যখন খ্রীস্টানের হস্তে মুসলমানেরা ধর্ম্ম ও সিংহাসন চূর্ণ হইতেছিল, তাহাদের চিহ্ন পর্যন্ত লুপ্ত হইতেছিল, তখন ভারতে মুসলমান মোগলশক্তি সমৃদ্ধির সিংহাসনে সমাসীন। সেই সিংহাসন হইতে শাহান্শাহ্গন স্পেনবাসী মুসলমানদীগের শোচনীয় অবস্থার প্রতি কোনরূপ সহানুভূতি প্রকাশের প্রয়োজন বোধ করেন নাই। আধুনিক যুগে ইউরোপীয় মহাযুদ্ধে বিপন্ন তুর্কীকে অবহেলায় পরিত্যাগ করিয়া মিসরের মুসলমান স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্যের পতাকা তুলিয়া ইংরাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়াছে। খ্রীস্টান ইংরাজের সাহায্য লইয়া আরব তাহার সহধর্মী তুর্কী ভাইকে স্বদেশ হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে। মুসলমান বলিয়া আরব তুর্কীর অধীনে জীবন যাপন করিতে সম্মত হয় নাই। ধর্ম-গুরু খলিফার প্রভুত্ব পর্যন্ত তাহারা অস্বীকার করিয়াছে।
ভৌগোলিক সীমা, ভাষা, আবহাওয়া ও আহার-পরিচ্ছদের বিভিন্নতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন দেশে নিতান্ত স্বভাবধর্ম অনুসারেই ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রমণ্ডল গড়িয়া উঠিয়াছে। খ্রীস্টান-ইউরোপে ইংরাজ, ফরাসী, জার্মানি, রাশিয়া যে নিয়মে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে পরিণত হইয়াছে, সেই একই কারণে মোসলেম এশিয়া ও আফ্রিকায় আরব, তুরস্ক, ইরান, আফগান, মিসর, মরক্কো, তিউনিস ও সুদান ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রমণ্ডলে পরিণত হইয়াছে। এমন কি, এক ভাষা সত্ত্বেও মরক্কোর মুসলমান মিসরের মুসলমানের সঙ্গে মিলিত হইয়া এক রাজত্ব গঠন করে নাই। সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও রাজ্য গঠনের এই স্বাভাবিক ক্রিয়া কি শুধু ভারতবর্ষেই বিফল বলিয়া প্রমাণিত হইবে? কেবল ভারতের মুসলমানগণই আপনাদের দেশ ভাষা ও রুচিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়া শুধু মুসলমান বলিয়া তুর্কী তাতার কাবুলের অধীনতা বরণ করিয়া লইবে?
সুতরাং তুরস্ক বা কাবুলের সঙ্গে মিত্রতা করিয়া ভারতে মুসলমান রাজত্ব স্থাপন করিবার অভিপ্রায়েই ভারতীয় মুসলমানগণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ-লাভের দিকে দৃষ্টি দিয়া বসিয়া থাকে ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে পৃথক-নির্বাচন বা নির্দিষ্ট অধিকার লাভের চেষ্টা করে, ইহা নিতান্তই অমূলক চিন্তা। তৈমুর লঙ্গ ও নাদির শাহ্ ভারতের বুক বহু মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত করিয়াছে। ভারতীয় মুসলমানের বহু ধনরতœ লুণ্ঠিত হইয়া কাবুল ও তাতারের পথে চলিয়া গিয়াছে। ইহা ভারতীয় মুসলমানগণ ভুলিয়া যাইতে পারে না। ভারতে মোসলেম রাজ্য স্থাপনের অমূলক আশঙ্কা যে কুহেলিকা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহা ভেদ করিয়া মুসলমানদিগের সাম্প্রদায়িক হিত-বুদ্ধির মূলে কি চিন্তা ক্রিয়া করিতেছে, তাহা এখন আমাদিগকে পরিষ্কার করিয়া বুঝিতে হইবে।
এক একটি পরিবারে যাহা ঘটে, এক একটি জাতির জীবন ও রাষ্ট্রীয় সুখ-দুঃখ তাহারই বৃহত্তর বিকাশ মাত্র। হিন্দু ও মুসলমান শুধু এক দেশবাসী বলিয়াই ভাই। কিন্তু পরিবাওে পরিবারে দেখিতে পাই, যাহারা এক রক্তের রক্ত, এক বৃন্তের ফুল, এক মায়ের সন্তান, সেই একান্ত সত্য-সহোদর ভাইগণ স্বার্থের জন্য, প্রয়োজনের নিমিত্ত, আত্মরক্ষার চিন্তায়, পরস্পরের সহিত বিস্ময়কর ও ভয়াবহ কলহে লিপ্ত হয়। দেখা যায়, কনিষ্ঠ সহোদর আপনার অধিকার যখনই ভালভাবে বুঝিয়া না পায়, তখনই জ্যেষ্ঠের নিকট হইতে তাহার সম্পত্তি পৃথক করিয়া লইবার দাবী উপস্থিত করে, এবং যে পর্যন্ত তাহার এই পৃথক অধিকারের দাবী পরিবার-মণ্ডলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্তৃক স্বীকৃত ও সম্পাদিত না হয়, সে পর্যন্ত সে কলহ করিতে, মামলা করিতে, এমন কি রক্তপাত করিতেও কুণ্ঠিত হয় না।
কনিষ্ঠ ভাইয়ের এক পৃথক অধিকার লাভের বুদ্ধি আসে কোথা হইতে? সাধারণতঃ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্বার্থপরতা ও অতিরিক্ত প্রভুত্ব-প্রিয়তা হইতেই ইহার জন্ম। ছোট ভাই যখন দেখিতে পায়, পরিবারের ধন-সম্পত্তি বড় ভাইয়ের ভোগে যেমন করিয়া লাগিতেছে তাহার নিজের ভোগে তেমন করিয়া লাগিতেছে না, সম্পত্তির উপর বড় ভাইয়ের প্রভুত্ব যেমন করিয়া চলিতেছে, তাহার নিজের অধিকার তেমন করিয়া চলিতেছে না, তখনই তাহার মনে পৃথক অধিকার লাভের চিন্তা মাথা তুলিয়া দেখা দেয় এবং সে তাহা লাভ করিবার জন্য বিবাদ করিতে প্রবৃত্ত হয়। সুবিধা ও ক্ষমতা যাহার হাতে থাকে, সে সাধারণতঃ তাহার অপব্যবহারই করিয়া থাকে। অপরের স্বার্থ ও অধিকার মানিবার ও বুঝিয়া দিবার সুবুদ্ধি অতি অল্প লোকের মধ্যেই দেখিতে পাওয়া যায়। এই নিমিত্ত অধিকাংশ পরিবারেই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অল্পবয়স্ক ও অনুন্নত কনিষ্ঠদিগের অধিকার ন্যায়ের সঙ্গে বুঝিয়া দিবার দিকে লক্ষ্য রাখে না। ফলে গৃহবিবাদ উপস্থিত হয় ও কনিষ্ঠ ভাইয়েরা বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। কনিষ্ঠ ভাইয়েরা যতদিন ছোট থাকে, যতদিন তাহাদের জ্ঞানবুদ্ধি পরিপক্ক না হয়, যতদিন তাহারা নিজেদের সত্তা ও অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হইয়া না ওঠে, ততদিন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রভুত্ব ও পরিবারের শান্তিতে কোনই বিঘœ উপস্থিত হয় না। কিন্তু এই প্রকার শান্তিকে শান্তি বলা চলে না। বিপদ আসে তখনই যখন ছোট ভাইগণ বয়স্ক, বুদ্ধিমান ও অধিকার-বুদ্ধিতে সচেতন হইয়া সংসারে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চায়, যখন তাহারা মানুষরূপে বাঁচিতে, বুঝিতে ও সকল অধিকার গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হয়। বড় ভাই যখন নিজের পতœীকে স্বর্ণালঙ্কারে মণ্ডিত করে, আপনার ছেলেমেয়েকে সুন্দর সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত করে, আর ছোট ভাই তাহার পতœী ও সন্তানদিগের অনুরূপ সুখ-সুবিধা বিধানের সুবিধা পায় না, প্রতি পদে সেখানে তাহার স্বাধীন চিন্তা ব্যাহত হয়, তাহার প্রাণের সাধ মনের মধ্যে গুমরিয়া ফিরে, তখনই তাহার মনোমধ্যে আপনার অধিকার পৃথক করিয়া লইবার চিন্তা জাগ্রত হয়।
প্রতি পরিবারে ভ্রাতৃ-বিরোধের ইহাই ইতিহাস। প্রত্যেক মানুষ আপনার স্বতন্ত্র সত্তার প্রকাশ পাইতে ইচ্ছা করে। ছোট ভাই তাহার অধিকারের জন্য যে বিরোধ করে, ধন-সম্পত্তি পৃথক করিতে সংগ্রাম করে, বড় ভাইয়ের স্বার্থপরতা হইতে তাহার জন্ম এবং ছোট ভাইয়ের আত্মচেতনা ইহাতেই ইহার প্রেরণা।
পরিবারিক জীবনে যাহা ঘটিতেছে, জাতীয় জীবনেও তাহা ঘটিতে পারে। মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যেমন আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চায়, সমষ্টিরূপে সে তেমনি আপনার বিচিত্র আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বতন্ত্র সত্তা প্রকাশ করিতে লালায়িত হয়। সহোদর যেমন সহোদরের সঙ্গে বিরোধ করে, আপনার অস্তিত্ব ও অধিকারের জন্য মুসলমানের পক্ষের তেমনই হিন্দুর সঙ্গে কলহ করা বিচিত্র নহে। হিন্দুর স্বার্থপরতা হইতে ইহার জন্ম, মুসলমানের আত্মচেতনা ও আত্মপ্রকাশের চিন্তা হইতে ইহার উৎপত্তি।
দোহাই:
মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর পুস্তাকাকারে অপ্রকাশিত রচনাবলী, আব্দুল কাদির সম্পাদিত, বাঙলা একাডেমী, কার্তিক: ১৩৭০, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশ: সওগাত, ৫ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, আষাঢ় ১৩৩৪।